চাকরি জীবিকা উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম। জীবিকার জন্য বেশির ভাগ মানুষের প্রথম পছন্দ চাকরি। সেখানে ব্যর্থ হলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অন্য পেশায় যায়। চাকরি হলো নির্দিষ্ট বেতনের বিনিময়ে অন্যের কাজ করা বা কারো অধীনে ক্রিয়া সম্পাদন করা। মূলত চাকরি নিয়োগক’র্তা কর্তৃক আরোপিত লিখিত বা মৌখিক শর্তাবলি পালনের চুক্তি। ইস’লামে চুক্তি পালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইস’লামের নির্দেশনা অনুযায়ী চাকরি করলে চাকরিতে ব্যয়িত সময় ও সেবা প্রদান ইবাদতে পরিণত হবে, ইনশাআল্লাহ।
চাকরির ক্ষেত্র বৈধ হওয়া : চাকরিকে ইবাদতে পরিণত করতে প্রথম যে বিষয়টি প্রয়োজন, তা হলো চাকরির ক্ষেত্র বৈধ হওয়া। চাকরির ক্ষেত্র বৈধ না হলে উপার্জিত অর্থ-সম্পদও বৈধ হবে না। কাজেই চাকরি নির্বাচন করার সময়ই এমন চাকরি পরিহার করতে হবে, যা ইস’লামে অনুমোদিত নয়। যেমন—সুদি কারবারের ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত বা মা’দকদ্রব্য প্রস্তুতকরণ, পরিবহন, পরিবেশনসংক্রান্ত চাকরি ইস’লামে অনুমোদিত নয়। জাবির (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) সুদখোর, সুদদাতা, সুদের হিসাবরক্ষক এবং তার সাক্ষীদ্বয়ের প্রতি লানত করেছেন এবং তিনি বলেছেন, তারা সবাই সমান অ’প’রাধী।’ (মু’সলিম, হাদিস : ৪১৭৭)
আরেকটি হাদিসে এসেছে, ইবনে উম’র (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ম’দ, ম’দ পানকারী, পরিবেশনকারী, বিক্রেতা, ক্রেতা, উৎপাদনকারী, যে উৎপাদন করায়, পরিবহনকারী, যার জন্য পরিবহন করা হয় সবার প্রতি আল্লাহ লানত করেছেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৬৭৬)
মৌলিক ইবাদতের অন্তরায় না হওয়া : চাকরি আর অর্থের মোহে পড়ে আল্লাহকে ভুলে গেলে হবে না; বরং ইস’লামের মৌলিক ইবাদত-বন্দেগি যেমন—নামাজ, রোজা, হ’জ, জাকাত যথাসময়ে আদায় করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সেসব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্ম’রণ হতে এবং নামাজ কায়েম ও জাকাত প্র্রদান হতে বিরত রাখে না, তারা ভ’য় করে সেদিনকে যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩৭)
পেশাদারি ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন : চাকরির ক্ষেত্রে সাধ্যমতো পেশাদারি ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পবিত্র কোরআন থেকে বোঝা যায়, চাকরিজীবীর মধ্যে দুটি গুণ থাকা একান্ত প্রয়োজন। এক. কাজের শক্তি-সাম’র্থ্য তথা পেশাদারি। দুই. বিশ্বস্ততা। শুয়াইব (আ.)-এর দুই কন্যা মু’সা (আ.)-এর কাজের শক্তি-সাম’র্থ্য এবং বিশ্বস্ততা প্রত্যক্ষ করেছিল। এরপর মু’সা (আ.) স’ম্পর্কে পিতাকে বলেছিল, ‘তাদের একজন বলল, হে পিতা! তুমি একে (মু’সা) মজুর নিযু’ক্ত করো, কারণ তোমা’র মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।’ (সুরা : কাসা’স, আয়াত : ২৬)
সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ : বেশির ভাগ চাকরিজীবীকে প্রতিদিন অনেকের মুখোমুখি হতে হয়। ছাত্ররা শিক্ষকদের, যাত্রীরা যান পরিচালনাকারীদের এবং অন্য সেবাগ্রহীতারা সেবাপ্রদানকারীদের দ্বারস্থ হয়। চাকরিজীবীদের তাদের কাছে আসা সবার সঙ্গে উত্তম ও শোভনীয় আচরণ একান্ত কাম্য। এটি উত্তম ইবাদতও বটে। আবু দারদা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন কর্মবিচারের পাল্লায় বান্দার সবচেয়ে ভা’রী ও মূল্যবান আমল হবে সুন্দর আচরণ। আর সুন্দর আচরণের অধিকারী মানুষ শুধু তার সুন্দর আচরণের কারণে নফল নামাজ ও রোজা পালন করার সওয়াব অর্জন করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০০৩)
দায়িত্ব পালনে অবহেলা নয় : ইচ্ছাকৃতভাবে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা ইস’লামে বৈধ নয়। কর্তব্যে অবহেলা বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন—ইচ্ছা করে দায়িত্ব পালন না করা, অযথা কালক্ষেপণ, বিলম্বে কর্মস্থলে উপস্থিতি, নির্ধারিত সময়ের আগে প্রস্থান, সেবা প্রদানে অলসতা ইত্যাদি। কর্তব্যে অবহেলার জন্য প্রত্যেককে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ইবনে উম’র (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোম’রা প্রত্যেকেই তার দায়িত্ব স’ম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৮৫৩; মু’সলিম, হাদিস : ৪৮২৮)
ক্ষমতার অ’পব্যবহার পরিহার : সব চাকরিজীবীরই কিছু ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ থাকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়’রানি করা, ভ’য়ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রভাব খাটিয়ে অন্যায়ভাবে স্বার্থ হাসিল করা ক্ষমতার সুস্পষ্ট অ’পব্যবহার। এভাবে ক্ষমতার অ’পব্যবহার করে কারো ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা বা পদ-পদবি ব্যবহার করে অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন করা ইস’লামের দৃষ্টিতে বড় অন্যায় ও জুলুম। চাকরিকে ইবাদত হিসেবে পরিগণিত করতে হলে এসব পরিহার করতে হবে। আবু হু’মাইদ আস-সাঈদি (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আসদ গোত্রের ইবনে লাতবিয়া নামক এক ব্যক্তিকে জাকাত উসুলের জন্য কর্মচারী নিযু’ক্ত করে কোথাও পাঠালেন। তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে বললেন, এগুলো আপনাদের অর্থাৎ রাষ্ট্রের আর এগুলো আমাকে উপহার দেওয়া হয়েছে। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারে দাঁড়ালেন। আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, ‘সে কর্মচারীর কী’ হলো, যাকে আমি দায়িত্ব দিয়ে পাঠালাম, আর সে বলে, এগুলো আপনাদের এবং এগুলো আমাকে হাদিয়া দেওয়া হয়েছে? সে তার ঘরে বসে থেকে দেখে না কেন, তাকে উপহার দেওয়া হয় কি না?’ (বুখারি, হাদিস : ২৪৫৭; মু’সলিম, হাদিস : ৪৮৪৩)
দু’র্নীতি পরিহার : কর্তব্যের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন কারো কাছ থেকে চাকরিজীবী কর্মক’র্তা-কর্মচারীদের উপহার গ্রহণ বৈধ নয়। এর মাধ্যমে কর্তব্য পালনে প্রভাব বিস্তার করা হয়। এভাবে সেবাপ্রার্থীদের ফাইল আ’ট’কে রেখে অর্থ দাবি করা বা অর্থ প্রদানের পরিবেশ তৈরি করে অর্থ আদায় করা অন্যায়, অবিচার ও দু’র্নীতি, যা ইস’লামে নিষেধ। আল্লাহ বলেন, ‘তোম’রা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ কোরো না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
পরিশেষে বলা যায়, উল্লিখিত বিষয়াবলি চাকরির ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করতে পারলে প্রথমত চাকরিতে কা’টানো পুরো সময় ইবাদত হিসেবে পরিগণিত হবে, দ্বিতীয়ত, চাকরিজীবীরা জনসাধারণের দোয়া ও ভালোবাসায় সিক্ত হবে। তৃতীয়ত, তাদের প্রতি জনগণের আস্থা-বিশ্বা’স সৃষ্টি হবে। চতুর্থত, দেশ দু’র্নীতিমুক্ত, সুখী ও সমৃদ্ধ হবে।